জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হন। এর আগের দিন ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন দলের দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। সেই থেকে টানা ১৬ মাস ধরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে আছেন তিনি।
এই দীর্ঘ সময়ে তিনি একবারের জন্যও দলীয় কার্যালয় ছেড়ে যাননি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এরইমধ্যে রিজভী আহমেদকে বিএনপির আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করে সমালোচনা করে আসছেন। সম্প্রতি বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত করে বিএনপি। এরপর বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করে দলীয় কার্যালয়ের মূল গেটে তালা লাগিয়ে দেয়। তাদের বিভিন্ন দাবির মধ্যে অন্যতম হলো- বিএনপির গঠনতন্ত্র অমান্য করে রিজভী আহমেদ দুটি পদ দখল করে আছেন। তিনি দলীয় কার্যালয়কে নিজের ঘর-বাড়িতে পরিণত করেছেন। এখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান নিয়ে তিনি বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে চলেছেন। তাকে অবিলম্বে দলীয় কার্যালয় ছেড়ে যেতে হবে।
এরইমধ্যে গত রোববার হঠাৎ রিজভী আহমেদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে তার কঠিন পেট ব্যথা শুরু হয়। পরে ব্যাপক বমিও হয়। এরপর থেকে গত কয়েকদিন ধরেই তিনি শিরায় স্যালাইন গ্রহণ করছেন। চিকিৎসকদের পরামর্শে তার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ আছে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও দলীয় কার্যালয় ছেড়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাননি রিজভী আহমেদ। এমনকী পারিবারিক পরিবেশে সেবা গ্রহণের জন্যও দলীয় কার্যালয় ছেড়ে যাননি নিজের বাসায়। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, অসুস্থ হয়েও কেন দলীয় কার্যালয় ছাড়ছেন না রিজভী আহমেদ।
ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ওমর ফারুক মুন্না দৈনিক জাগরণকে বলেন, রিজভী ভাইকে কার্যালয় ছেড়ে যেতে হবে। তিনি কার্যালয় ছেড়ে যদি হাসপাতালে যান, সেখানে যদি তাকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হয় সেই খরচ আমি দেব। তাকে দলীয় কার্যালয়ে বসে নোংরা রাজনীতি করতে দেব না।
ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিয়া রাসেল দৈনিক জাগরণকে বলেন, রিজভী ভাই আমাদের সিনিয়র বড় ভাই। তিনি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের মতো ভাইটাল পদের নেতা। অথচ দুঃখজনক বিষয়- তিনি একইসঙ্গে দপ্তর সম্পাদকের পদও দখল করে আছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- বিএনপির মতো এত বড় ও জনপ্রিয় দলে কি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করার মতো আর কোনো নেতা তৈরি হয়নি। কী কারণে তিনি দপ্তরের পদ ছেড়ে পার্টি অফিস থেকে বের হতে চান না, এটা সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন।
এ সব বিষয়ে কথা বলার জন্য বুধবার (১২ জুন) সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরে দৈনিক জাগরণের এ প্রতিবেদক দেখা করেন বিএনপির রাজনীতিতে আলোচিত রুহুল কবির রিজভী আহমেদের সঙ্গে। আলাপকালে তিনি জানান, তিনি আগের চেয়ে এখন অনেকটা সুস্থবোধ করছেন।
রিজভী আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, কয়েকদিন পর আজ (বুধবার) কিছুটা সুস্থ বোধ করছি। কয়েকদিনের মধ্যে আজই প্রথম বিকালে পানি পান করেছি। গত কয়েকদিন ধরেই চিকিৎসকদের পরামর্শে সকল প্রকার খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে।
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রিজভী আহমেদের সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বলার সময় সেখানে তাকে দেখতে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি মিনিট পাঁচেক সময় রিজভী আহমেদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান। একই সময় তাকে দেখতে আসেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ ও তরুণ দলের সভাপতি ডা. আবু বকর সিদ্দিক।
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের ৬ তলা ভবনের তৃতীয় তলায় দলের দাপ্তরিক কার্যালয়। সেখানে বিএনপির মহাসচিবের কক্ষ, সংবাদ সম্মেলন কক্ষ, দাপ্তরিক বিভাগ, একটি রান্নাঘর, তিনটি টয়লেটসহ মোট ৬টি কক্ষ আছে। এর মধ্যে রিজভী আহমেদ প্রায় সময়ই দপ্তর বিভাগের নিজের কক্ষে অবস্থান করেন। তাকে ঘিরে দিনের প্রায় সময়ই বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের বেশকিছু নেতাকর্মী অবস্থান নিয়ে থাকেন। রিজভীর বসার পেছনে (দক্ষিণে) একটি ছোট পরিসরের কক্ষে তিনি দিনের বিশ্রাম সারেন, রাতে ঘুমান। বর্তমানে তিনি সেই ছোট্ট কক্ষে শুয়ে আছেন। হাতে চলছে স্যালাইন। পাশে বসে ছিলেন তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা আইভী।
দৈনিক জাগরণকে রিজভী আহমেদ জানান, তার অসুস্থতা র্দীর্ঘদিনের। আশির দশকের শেষ দিকে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলি তার মেরুদণ্ড ভেদ করে যায়। সেই থেকেই তিনি কার্যত অসুস্থ। গুলি লাগার কারণে তার খাবার হজমে গুরুতর সমস্যা হয়। খাবার তার খাদ্যনালীতে আটকে যায়। চিকিৎসকদের ভাষায় এ রোগের নাম সাব একিউট ইন্টেস্টেনাল অবস্ট্রাকশন।
বিএনপির সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দৈনিক জাগরণকে জানান, ১৯৮৪ সালে রিজভী আহমেদের পেটে ও মেরুদণ্ডে গুলি লাগার কারণে মাঝে মাঝেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে আগেও বেশ কয়েকবার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি জানান, রিজভী আহমেদের যিনি অপারেশন করেছিলেন তিনি দেশের খুব সিনিয়র একজন চিকিৎসক অধ্যাপক সানোয়ার হোসেন। এবারও আমরা উনার কাছ থেকে কনসালটেশন নিয়েছি। তিনি এসে দেখেও গেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যে চিকিৎসা উনাকে দিচ্ছি তা ঠিক আছে।
ডা. রফিক আরও বলেন, এই মুহূর্তে রিজভী আহমেদকে হাসপাতাল বা বাসায় নেয়ার তেমন প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি অসুস্থ হওয়ার পর আমরা তাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য বলতে পারেন একটি ‘মিনি হসপিটাল’ বানিয়ে ফেলেছি। সেখানে তার যে চিকিৎসা প্রয়োজন তা চলছে। গত কয়েকদিন পর আজ আমরা তাকে কিছুটা ওরাল খাবার সাজেস্ট করেছি। তাকে পানি পান করতে দিয়েছি। আমরা দেখতে চেয়েছি, তার সাব একিউট ইন্টেস্টেনাল অবস্ট্রাকশন কতটা কমেছে। কতটা কাজ করছে। এখন পর্যন্ত যা দেখতে পাচ্ছি তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এ কারণে এই মুহূর্তে তাকে হাসপাতালে বা বাসায় নেয়ার প্রয়োজন নেই।
হাসপাতাল বা বাসায় ফেরার প্রয়োজন অনুভব করছেন কি না জানতে চাইলে রিজভী আহমেদ বলেন, আগের চেয়ে কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি। বমি বন্ধ হয়েছে। পেটের ডান পাশের তীব্র ব্যথা এখন নির্দিষ্ট স্থানে আছে, তবে তা আগের চেয়ে কম। তাই আগে দেখি, পরে হাসপাতাল বা বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। এখনও এ বিষয়ে ভাবছি না।
অসুস্থ স্বামী রিজভী আহমেদকে পারিবারিক পরিবেশের জন্য বাসায় নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন কি না- রিজভী আহমেদের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা আইভীকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি দৈনিক জাগরণকে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তখন রিজভী আহমেদই এসব কথা বলেন।
এদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের স্টাফ রফিকুল ইসলাম রফিক দৈনিক জাগরণকে জানান, বুধবার দুপুরে রিজভী আহমেদকে দেখতে এসেছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সন্ধ্যার আগে এসেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নিপুন রায় চৌধুরী। এছাড়া, বিএনপি ও অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরাও এসেছেন।
উৎসঃ দৈনিক জাগরণ